সেলস প্রফেশন, বিশ্বব্যাপী সমাধৃত অসাধারণ আর রোমাঞ্চকর এক পেশা। প্রচুর চাহিদা, ফ্লেক্সিবিলিটি, ক্যারিয়ারে দ্রুত উন্নতি, সর্বদা নতুনত্বের শিহরণ আর ভালো ইনকামের কারণে সেলস পেশা বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়। প্রতিষ্ঠান, পণ্য বা সেবার ধরণ এবং ব্যক্তির দক্ষতার উপর ভিত্তি করে প্রত্যেকের সেলস ক্যারিয়ারের আসলে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
ক্যারিয়ার হিসেবে সেলস কে নির্বাচন করার পূর্বে এই সেক্টর থেকে আপনার চাওয়া বা প্রত্যাশা সম্পর্কে ভেবে দেখা উচিৎ। প্রায়শই দেখা যায় যে অনেক গ্র্যাজুয়েট অন্ধভাবে সেলস প্রফেশনে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে অনুধাবন করেন যে এই চ্যালেঞ্জিং পেশা আসলে তাদের জন্য নয়। আবার অনেক সময় কোনরূপ পরিকল্পনা ছাড়াই কোন কিছু না জেনে বুঝে যেনতেন কোম্পানির সেলসে প্রবেশর অল্পদিন পর সম্বিৎ ফিরে আসে এবং তাতে করে পুরো সেলস ইন্ড্রাষ্টি সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয়।
বিক্রয় পেশায় যোগদানের পূর্বে কিছুটা হোমওয়ার্ক করার পরামর্শ দেবো আমি। এই যেমন আপনি কেন আসতে চান এই পেশাতে, সেই সাথে কাঙ্ক্ষিত ইন্ড্রাষ্টি সম্পর্কে তথ্য উপাথ্য সংগ্রহ করা, পন্য বা সেবাখাত সম্পর্কে ধারণা নেয়া, পছন্দের প্রতিষ্ঠান সমূহে কর্মীগণ কিভাবে কাজ করেন সেসব জানার চেষ্ঠা করা এবং প্রতিষ্ঠান সমূহের কালচার আর কর্মপরিবেশ কেমন তাও জেনে নিয়ে তবেই সিদ্ধান্তে আসা উচিৎ বিক্রয় জগতে ক্যারিয়ার গড়বেন কিনা।
আমাদের চারপাশের সব ধরণের পেশাতেই সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে যা জেনেশুনেই গ্র্যাজুয়েটদের পা বাঁড়াতে পরামর্শ দেবো। বিক্রয় পেশাতে যেমন আকর্ষণীয় সেলারীর পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে সেলস কমিশন, দৈনিক ভাতা, মোবাইল বিল, কার এলাউন্স, বিভিন্ন রকমের বোনাস, বিদেশ ট্রিপসহ নানারকম আর্থিক সুবিধাদি পাওয়া যায়। সেই সাথে হালের সিক্স ডিজিটের সেলারী আর দ্রুত পদোন্নতির সুযোগ এই সেক্টরের তুলনামূলক একটু বেশী লক্ষ্য করা যায়। কোম্পানি এতোসব সুবিধাদি দিয়ে থাকে কারণ এই সেলস টিমই কোম্পানির জন্যে সরাসরি রেভিনিউর যোগান দিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে উচ্চ বেতন যেমন আছে তেমনি আছে অধিক দায়-দায়িত্ব আর নিদিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণের তাগিদ। আছে অধিক কাজের চাপ, অতিরিক্ত ধকল আর প্রতিদিনকার হাজারো চ্যালেন্সসমূহ যা সামলেই সামনে এগিয়ে যেতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় যে, অনেকেই নিত্যদিনকার কাজের চাপ আর অতিরিক্ত ধকল সামলে ভালো পারফর্ম করতে পারেননা। ফলে একদিকে যেমন অতিরিক্ত আর্থিক-সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত হোন, তেমনি প্রতিযোগিতায়ও অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকেন।
তবে অন্যন্য পেশার তুলনায় এখানে কাজের স্বাধীনতা একটু বেশীই ধরা দেয়। সুযোগ আছে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ভিন্ন সংস্কৃতি আর শতশত মানুষের সাথে মেশার, সেই সাথে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা আর চলাফেরা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ যা অন্য পেশায় তুলনামূলক কমই পাওয়া যায়। তাছাড়া দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে ফিল্ড বা অন-জব ট্রেইনিংয়ের সুযোগতো রয়েছেই।
প্রতিকূলে, একবার চিন্তা করুন তো–আপনার কাজের স্বাধীনতা আছে ঠিকই কিন্তু আপনি অফিস আর পরিবার পরিজন থেকে অনেক দূরে একা নতুন এক অচেনা জায়গায় অবস্থান করছেন। যেখানে অফিস কতৃক অর্পিত গুরু দায়িত্বসমূহ যথা ডিলার/ডিস্টিবিউটর ম্যানেজ করা, নিযুক্ত টেরিটরির ব্যবসার প্রসার ঘটানো, টিম লিডার হলে টিম সামলানো, স্টেকহোল্ডারদের সাথে হেলদি রিলেশনশীপ গড়ে তোলা এবং এসবের পাশাপাশি নিজের জন্যে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করাসহ ব্যাক্তিগত প্রাত্যহিক সবকিছুই একা সামলাতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় সেলফ মোটিভেশন না থাকলে অনেকেই সবকিছু সামলে নিতে পারেননা, খেই হারিয়ে পেশা পরিবর্তনের চেষ্ঠা করেন। কাজেই সেলস সেক্টরে আসার পূর্বে এসব বিবেচনায় নেয়া খুব জরুরী বলে আমি মনে করি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সেলস জগতে একটি নিদিষ্ট টেরিটরি নিয়ে কাজ করা মানে নিজে একটি ছোটখাটো ব্যবসা চালানোর মতো চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার যেখানে আপনি কোম্পানি থেকে নানাবিধ সাপোর্ট আর দিকনির্কোদেশনাও পেয়ে থাকবেন। আসলে সেলস ক্যারিয়ার আপনাকে কিছুটা উদ্যোক্তার স্বাদ এনে দেবে যেখানে আপনি কোম্পানির নিয়মের মধ্যে থেকে নিজের সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগিয়ে টেরিটরির ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার সু্যোগ পাবেন। আর আপনার টেরিটরিতে আপনিই হলেন একজন সিইও তথা মার্কেটিং, সেলস কিংবা অপারেশনাল হেড।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, সেলস প্রফেশনে কার্য সম্পাদনে অনেক পারদর্শী হওয়া চাই কারণ আপনার টেরিটরির যেকোন কাজের জন্যে আপনিই প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তি, যিনি প্রতিনিয়ত হাজারো সমস্যা সমাধানে সদা তৎপর হয়ে কোম্পানির ব্যবসাকে সামনে এগিয়ে নেবেন।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন যে, অনেক চাকুরীতেই কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সংখ্যাত্বক উপস্থাপনা তেমন থাকেনা যেমনটি আছে সেলস জবের ক্ষেত্রে। প্রতিদিনকার সেলস ফিগার দেখেই সরাসরি আপনার কাজের ফলাফল জানা যাবে; ফলে এটি অন্য যেকোন জবের চেয়ে অধিক স্পষ্ট আর পারফর্মেন্স নির্ভর। আর তাই এই সেক্টরে ভালো কাজের মূল্যায়ন তথা পুরষ্কার হিসেবে সেলস কমিশন, বিদেশ ট্রিপ তো জুটেই; তার উপর মেলে নানান অফিসিয়াল স্বীকৃতি যা নিজেকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। আমার কাছে মনে হয়- সেলস জবে নিয়মিত পারফর্মেন্স করে যেতে পারলে অন্য যেকোন জবের তুলনার ক্যারিয়ার কন্টোল নিজে কাছে থাকে, মনোবল ঠিক রেখে ভবিষৎ ক্যারিয়ার পরিকল্পনা সাজানো সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
আপনি নিশ্চয় করে আমার সাথে একমত হবেন যে, জীবন সর্বদা আপনাকে কেবল ভালো কিছু উপহার দিয়ে যাবে তা নয়; বহমান নদীর মতো জীবনও কখনো কখনো থমকে দাঁড়াবে। মাঝেসাঝে সেলস জবে পারফর্ম করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। জানেনতো, সেলস সেক্টরে সত্যিই প্রতিযোগিতা আর নানামূখী কাজের চাপ অনেক বেশী, রয়েছে টার্গেট মিট করার অদৃশ্য এক চাপ। কোন কারণে পারফর্মেন্স একবার খারাপ হলে একদিকে যেমন নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, তেমনি বাড়তে থাকে মানসিক চাপ অনুভূত হওয়া যা ক্রমান্বয়ে মানসিক পীড়নে রুপ নেয়; এমনকি জবের প্রতি অসন্তুষ্টিও চলে আসতে পারে কিন্তু তাতে করে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না বরং নিয়ম মেনে ডিফেন্সিভ খেলে যেতে হবে; চার-ছক্কা মারার জন্যে লুস বলের অপেক্ষা করতে হবে।
আমাদের দেশে সেলস প্রফেশনে মার্কেটিং পড়ুয়াদের আধিক্য থাকলেও, অন্য অনেকেই নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তি, দক্ষতা আর যোগ্যাতা দিয়ে অনেক উঁচু পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনি যদি সত্যি সত্যিই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরের নানারকম চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন তবে আপনি সেলস সেক্টরে এক রোমাঞ্চকর ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবতেই পারেন। এই সেক্টর আপনাকে স্বাগত জানাবে সময় ব্যবস্থাপনা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা বা পার্সোনাল স্কিলস, যোগাযোগের দক্ষতা, প্রডাক্টটিভ ক্যাপাসিটি, ব্যবসায়িক নানান অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে পরিপূর্ণ এক সাফল্যময় ক্যারিয়ারের। একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন যে অনেক নামীদামী প্রতিষ্ঠান উচ্চ পদে নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত সেলস সেক্টরে অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
আগ্রহী নবীণেরা যদি সেলস সেক্টরের বিভিন্ন ইন্ড্রাষ্টি আর কাজ সম্পর্কে সম্যাক ধারণা আর যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পারেন তবে তা সাফল্য লাভে আপনার জন্যে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি আরো পরামর্শ থাকবে আগেভাগে চিন্তা ভাবনা করুন, প্রয়োজনে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিন; তারপর সেলসকে ক্যারিয়ার হিসেবে নির্ধারণ করুন। কারণ যে কাজ করে আপনি আনন্দ পাবেননা সেই কাজে সহজে সাফল্যও ধরা দেবেনা। আর নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে এই আর্টক্যালটি পড়ে দেখতে পারেন ঃলক্ষ্য যখন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান: নিয়োগ প্রক্রিয়া
ক্যারিয়ার শুরুর সময়ে অনেকেই আকর্ষণীয় বেতনাদির দিকে অধিক মনোযোগী হতে দেখা যায়। অনুগ্রহ করে ক্যারিয়ারের প্রারম্ভিককালে শুধুমাত্র আর্থিক সুবিধাদির কথা চিন্তা করবেননা, লংটার্ম ক্যারিয়ারের কথা ভাবুন, লার্নিংয়ের উপর জোর দিন, কাজ শিখুন; একসময় অর্থকড়ি আপনার পেছনে দৌড়াবে। আপনি বরং নিজের শক্তির দিকগুলোর দিকে ফোকাস করার পাশাপাশি খোঁজে বের করুন কিসে আপনি শ্রেষ্ঠতর আর কিসে আপনার উন্নতির জায়গা আছে।।
সবশেষ কথা হচ্ছে, নিজের দক্ষতা আর যোগ্যতা বিবেচনায় না এনে শুধুমাত্র কারো সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যেমন নিদিষ্ট ক্যারিয়ার নির্বাচন করা উচিৎ নয়; ঠিক তেমনি একক কোন ব্যাক্তি বিশেষের ব্যর্থতায় নিরুৎসাহিত হয়ে নিজের কাঙ্ক্ষিত জব সেক্টর বর্জনও পুরোপুরি অনুচিত।
শুভকামনা। শুভহোক আপনার পথচলা।
পড়ুন সেলস ক্যারিয়ারের শুরুতে কি করবেন?
Follow me on Facebook . Check out my Website .
1 Comment
[…] আমরা সবাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের সাথে খুব পরিচিত। আর লিঙ্কডইন হচ্ছে এমন এক প্রফেশনাল সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট যেখানে আপনি কর্পোরেট জগতের প্রায় সবাইকেই খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি খুঁজ পেতে পারেন অসংখ্য জব সার্কুলারের। তাই আর দেড়ি না করে আজই প্রোফাইল খুলে ফেলুন গুরত্বপূর্ণ এই সাইটটিতে । রোডম্যাপ টু সেলস প্রফেশন […]